বাদল কৃষ্ণ দাস ::
হাওর বিধৌত জেলা সুনামগঞ্জ। এই সুবিশাল হাওর এলাকাজুড়ে রয়েছে ছোট-বড় শত শত বিল-জলমহাল। আর দিগন্তজোড়া এই হাওর জলাধারের মৎস্যভান্ডার প্রতিবছরই দেশীয় অর্থনীতিতে রাজস্ব আহরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। হাওরাঞ্চলে ২০ একরের ঊর্ধ্ব আয়তনের বিল জলমহালগুলো জেলা প্রশাসন এবং ২০ একরের নিচে আয়তনের জলমহালগুলো উপজেলা প্রশাসন থেকে ইজারা দেওয়ার নীতিমালা রয়েছে। আর এসব জলমহাল তিন বছর থেকে ছয় বছর মেয়াদী ইজারা নিয়ে থাকে জলমহালের নিকটবর্তী মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির লোকজন।
সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন থেকে ১৪৩০ থেকে ১৪৩৫ বঙ্গাব্দ মেয়াদে যে সব বিল জলমহাল উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ইজারা প্রদান করা হয়, এর মধ্যে জামালগঞ্জের বড়চাটুয়া গ্রুপ জলমহালও রয়েছে। কিন্ত এই জলমহালে দু’বছরেও কোনো উন্নয়ন প্রকল্প দৃশ্যমান করেনি ইজারাদার সমিতি। তলা শুকিয়ে মাছ ধরার পর জলমহালে পানি ছেড়ে দেয় ইজারাদার। জানা গেছে, এলাকার একশ্রেণীর প্রভাবশালী অর্থ-লগ্নীকারী ব্যক্তিরা নিবন্ধিত মৎস্যজীবীদের সামনে রেখে বিভিন্ন সমবায় সমিতির নামে এসব বিল জলমহাল ইজারা নিয়ে থাকেন। যে কারণে সমিতির তালিকাভুক্ত কোনো মৎস্যজীবী এর মুনাফা পান না। এমনটাই চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে। মূলত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে ছয় বছর মেয়াদে ইজারা দখল নিয়ে জলমহাল ধ্বংস করা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এদিকে জলমহালের তলা শুকিয়ে মৎস্য আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ হলেও ইজারাদারেরা জলমহাল নীতিমালায় নিষেধাজ্ঞার কোনো তোয়াক্কাই করছেন না।
জামালগঞ্জ উপজেলার পাগনার হাওরে বড়চাটুয়া গ্রুপ জলমহালটি প্রায় দুই যুগ ধরে একশ্রেণীর অমৎস্যজীবী ইজারাদারদের খপ্পরে পড়ে লন্ডভন্ড- হয়ে আসছে। উপজেলার পাগনার হাওরের পূর্বাংশে মাতারগাঁও, উজিরপুর, রফিনগর, এই তিনটি মৌজায় পাঁচটি দাগে প্রায় ২৯.৭৬ একর এলাকা নিয়ে এই জলমহালের অবস্থান। এর বর্তমান বাৎসরিক ইজারামূল্য ৪ লাখ ৭০ হাজার ২৮৭ টাকা। চলতি মেয়াদে ১৪৩০ বাংলা সন থেকে ১৪৩৫ বাংলা পর্যন্ত জলমহালটির ইজারা নিয়েছে জামালগঞ্জ উপজেলার ভীমখালী ইউনিয়নের কলকতখাঁ গ্রামের পাতাকুঁড়ি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেড। অভিযোগ রয়েছে, জলমহাল নীতিমালাকে পাশ কাটিয়ে রহস্যজনকভাবে উক্ত সমিতি এই ইজারা বাগিয়ে নেয়। পরে পার্শ্ববর্তী শান্তিগঞ্জ উপজেলার শিমুলবাঁক ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামের অমৎস্যজীবীদের কাছে বেশি দামে সাব-ইজারা দিয়ে দেয়।
উল্লেখ্য যে, গত মৌসুমেও এই সাব-ইজারাদার জলমহালের চারটি পার্ট তলা শুকিয়ে মাছের আধার তছনছ করে কোটি টাকার মাছ বিক্রি করে। জলমহালের কোনো প্রকার উন্নয়ন কাজ না করেই বিল-জলমহালে পানি ভর্তি করে চলে যান। চলতি মৌসুমেও ইতিমধ্যে দুটি পার্ট থেকে মাছ ধরা হয়ে গেছে। এতে প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাছ বিক্রি হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। এখন অন্য দুটি পার্টেও তলা শুকানোর প্রক্রিয়া চলছে। এতে করে প্রতি বছরই মৎস্য প্রজাতি সমূলে নিধন করা হচ্ছে। যে কারণে মাছের বংশ বিস্তার ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়ে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দু’বছর আগে এক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার হস্তক্ষেপে এই জলমহাল ইজারা বন্দোবস্ত পায় এই সমিতি। ইজারাদার সিন্ডিকেট প্রভাবশালী হওয়ায় প্রতিবারেই নানা রকম কৌশলে তারা বড়চাটুয়া গ্রুপ জলমহালের ইজারা নিয়ে আসছেন। এতে নিকটবর্তী অন্যান্য সমিতিগুলো ন্যায্যতার ভিত্তিতে ইজারা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জলমহালের উপকারভোগী এলাকাবাসী এবং জলমহালের নিকটবর্তী অন্যান্য সমিতিগুলো রাজনৈতিক পক্ষপাত হস্তক্ষেপে দেওয়া এই ইজারা বাতিল করে নিরপেক্ষ পুনঃইজারা প্রদানের দাবি জানিয়েছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে সংশ্লিষ্ট ইজারাদার পাতাকুঁড়ি মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যায়নি। বড় চাটুয়া গ্রুপ জলমহালের পানি সেচে মাছ ধরার বিষয়ে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান বলেন, আমি আজই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবো।
জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, উন্নয়ন কাজ যেহেতু করে নাই, তাহলে উনাকে চিঠি দিয়ে উন্নয়ন কাজ করতে বলবো। আর বিল সেচে মাছ ধরে নিয়ে, আবার জলমহালে পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টা আমাকে কেউ জানায় নাই। যদি বিল সেচে মাছ ধরে তবে এর সত্যতা যাচাই করে এই জলমহালের ইজারা বাতিল করে দেবো।
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
জামালগঞ্জের বড়চাটুয়া গ্রুপ জলমহাল ইজারাদারের ‘কৌশলে’ জলমহালের সর্বনাশ
- আপলোড সময় : ১১-০৩-২০২৫ ১২:৩০:৪৪ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ১১-০৩-২০২৫ ১২:৩৪:০৪ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ